ধর্ষিত
-রেহানা দেবনাথ
বাঁশি আজ কালীপূজার দিন কিছুতেই ঘর থেকে বেরোয় না। তবুও বেরোতে হলো বাবার বুকে ব্যথায় হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাওয়ার দরুন টাকাও কম নিয়েছিল তাই আবার বাড়িতে ফিরে এসে টাকা নিতে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়।অন্ধকারে গ্রামের শেষে মাঠের মাঝখান দিয়ে সরু মাটির রাস্তাটায় পা রাখতেই বাঁশির সারা শরীর কেঁপে উঠলো,গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলো।চোখের সামনে পাঁচ বছর আগের সেই কালীপূজার রাতের বীভৎসতার ছবি ভেসে উঠলো। সেদিন বিকেলে সৌরভ ব্যাঙ্গালোর চলে যায় কাজের সূত্রে ওকে না জানিয়ে। যখন ওদের বাড়িতে গিয়ে খবরটা জানতে পারে তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে তবুও সে সব ভুলে ছুট লাগায়। অমাবস্যার সন্ধ্যায় গ্রামের বাইরের চারিদিকটা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। গ্রামের শেষে সরু মাটির রাস্তা শেষে পাকা রাস্তায় ওঠার আগেই চারটে কালো মূর্তি তার দিকে এগিয়ে এলো সে কিছু বোঝার আগেই মুখ চেপে মাঠের মাঝখানে নিয়ে গেল। একজনে টান মেরে তার শাড়ি খুলে দিল, দুজনে মিলে ঘাসের উপর শুইয়ে দিল, আরেকজন তার মুখটা যেই বাঁশির মুখের কাছে আনলো তখনই বাঁশি সজোরে পা দিয়ে একজনকে লাথি মারলো আর জয় মা কালী বলেই জোরে হ্যাঁচকা দিয়ে দুটোকে ফেলে দেয়। গ্রামের ছেলেরা যখন ক্যারাটে শিখত তখন সে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে দেখত আর বাড়িতে এসে প্রাকটিস করত সেই সুবাদেই চারটেকে কাহিল করে দেয়। কিন্তু চারমূর্তির একজন পালাবার আগে ওর মাথায় লাঠি দিয়ে সজোরে মারে। বাঁশি অজ্ঞান হবার আগে দেখে যে চারমূর্তি দৌড়ে অন্ধকারে মিশে যায়। পরেরদিন সকালে যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে দেখে বাড়িতে শুয়ে আছে।একজন ডাক্তার মাথায় ব্যান্ডেজ করছে তার পাশে দুজন পুলিশ আর প্রতিবেশীরা ভিড় করে দরজায় উঁকি দিচ্ছে! পুলিশকে যখন সব ঘটনা জানায়। এরপর গ্রামের লোকজন আত্মীয় স্বজন সবাই আসে ওর থেকে ঘটনা জানতে চায় ও সত্যি কথা বলে কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চায় না! সন্দেহের চোখে তাকায়।গ্রামে রটে গেল বাঁশী ধর্ষিত হয়েছে। তার দুদিন পর সৌরভের বাড়ি থেকে বিয়েটাও ভেঙে দিলো। বাঁশির বাবা মা জায়গা জমি বেঁচে অন্য গ্রামে চলে যাবার কথা বলে কিন্তু বাঁশিই রাজী হয় নি।সে সৌরভের অপেক্ষা করতে থাকে। তার বিশ্বাস কেউ না বুঝলেও দু’ বছর পর ফিরে এসে সৌরভ তাকে ঠিক বুঝতে পারবে! আবার তারা একসাথে মিলে নতুন সংসার করবে। যতোই হোক ছোটবেলা থেকে দুজনে একসাথে বড় হয়েছে, ভালোবেসেছে তার সব কষ্ট শেষ হয়ে যাবে সৌরভ এলে। গ্রামের মানুষদের সহানুভূতি, কটূক্তি, সমালোচনা, অবহেলা, বক্র দৃষ্টি সব উপেক্ষা করে সে গ্রামে থেকেই গ্রাজুয়েশন শেষ করে। তারপর গ্রামের হাই স্কুলে শিক্ষকতা করে আর গ্রামের গরীব ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায় পড়ায়। বিয়ের জন্য ওর বাবা কয়েকটি পাত্র দেখে তারা পাত্রী দেখতে আসার আগেই লোকেদের মুখে সব শুনে কেটে পড়ে! শুধুমাত্র স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক নবীন তাকে বিয়ের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বাঁশি রাজী নয়! সে বাবাকে বলে দিয়েছে “আমি বিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না, সৌরভের অপেক্ষা করবো।” কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাঁশি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। হঠাৎ একটা ছায়া মূর্তিকে দেখে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ঘেমে গেল। দ্রুত গতিতে মানুষটিকে এগিয়ে আসতে দেখে আরও ভয় পেয়ে গেল। চিৎকার করতে লাগলো “কে? কে ওখানে? কাছে আসবে না বলছি! ছায়া মূর্তিটি উত্তর দেয় “আমি সৌরভ, ঠাকুর মশাইয়ের ছেলে। তুমি কে? গলাটা কেমন চেনা চেনা লাগছে!!” বাঁশি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, এ কার দেখা সের পেলো! যার জন্য পাঁচটি বছর হয়ে গেল অপেক্ষা করে বসে আছে সেই সৌরভের।একটা কালীপূজার দিন যাকে হারিয়ে ফেলেছিল আজ আবার সেইদিনে তাকে ফিরে পেল! সৌরভ কাছে এসে বললো “বাঁশি! তুমি বেঁচে আছো! তবে যে পাঁচ বছর আগে বাবা বলেছিলো একটা দুর্ঘটনায় তুমি মারা গেছ!তার কারণেই আমি এতদিন গ্রামে ফিরতে পারিনি।শুধুমাত্র মায়ের জোরাজুরিতে বাবার এক বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছি” বাঁশির কানে যেন কোনো কথাই ঢুকলো না। সে সৌরভকে পেয়ে আগে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ধাতস্থ হয়ে বাস রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সেদিনকার সব ঘটনা বলে। সৌরভ বিস্ময়ে বলে “তুমি সত্যি কথা বলছো! সেদিন চার চারটে লোক তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারে নি! দেখো আমার কাছে কোনো কিছু লুকিও না,আমি তোমায় এখনো ভালোবাসি তাই তোমার সব কিছু জেনে শুনেও আমার বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। জানি এই ঘটনার জন্য পরোক্ষভাবে হলেও আমি কিছুটা দায়ী, তার প্রায়শ্চিত্ত তো করতেই হবে।”বাঁশি অবাক হয়ে সৌরভের দিকে চেয়ে থাকে! রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলোয় ওর মুখটা কেমন অচেনা লাগছে। সৌরভের চোখ দুটোতে অবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। সৌরভ অবলীলায় বলতে থাকে “আচ্ছা ওরা তোমায় কেন ধর্ষণ করতে চাইলো? তুমি কি আগে থেকেই ওদের চিনতে? তুমি কি ঘটনার পর ডাক্তার দেখিয়েছিল? এই ঘটনার জন্যই কি তোমার কোথাও বিয়ে হয় নি?” বাঁশির বুকটা ফেটে যেতে লাগলো এই মানুষটার জন্য সে এতদিন অপেক্ষা করছিল যে এসে তার দু’চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে তার কষ্টটা ভাগ করে নেবে! বাঁশির গলার নীচে কষ্টগুলো দলা পাকাতে থাকলো। দু’চোখে জল এসে গেল অনেক কষ্টে চেপে রেখে সৌরভকে বললো “আমি ধর্ষিত হয়েছিলাম শুধুমাত্র সেদিন নয় আরও অনেকদিন ধরে।এখনও হই প্রতিনিয়ত! এরজন্য তোমার কোনো দোষ নেই। সবই আমার ভাগ্য! আর আমাকে তোমায় দয়া করে বিয়ে করতে হবে না! আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। তোমার আমার পথ আলাদা হয়ে গেছে, সেখানে আর একসাথে চলা হবে না। আমি পাঁচ বছর আগেই তোমার কাছে মরে গিয়েছিলাম তাই আমায় মৃত ভেবে যে কাজের উদ্যেশ্যে গ্রামে ফিরেছ, সেটাই আগে করো! আর আমিও আমার উদ্যেশ্যের পথে পা বাড়াই কারণ আমি আজ থেকে মুক্ত! কথাটা বলে বাঁশি অটোয় উঠে চোখের জল মুছে হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়।